বাউল সম্রাট লালন সাঁই গড়াই সেই কবে কোলে করে বয়ে এনেছিলে তাঁরে
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাববাদী দরবেশ
তাঁকে ঘুম পাড়ায়ে রেখেছো কালীগাঙের পাড়ে
এক তারাতে যাঁর সুর আজ জাগায় বাংলাদেশ।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাববাদী দরবেশ
তাঁকে ঘুম পাড়ায়ে রেখেছো কালীগাঙের পাড়ে
এক তারাতে যাঁর সুর আজ জাগায় বাংলাদেশ।
গড়াই নদী কাকে বয়ে এনেছিল? কাকে বিশ্বেও শ্রেষ্ঠ ভাববাদী দরবেশ বলা হয়? কালীগাঙের পাড়ে ঘুমিয়ে আছেন কে? কার এক তারার সুরে বাংলাদেশ জাগে? এই চারটি প্রশ্নের উত্তর কিন্তু একটি। তা হলো বাউল সম্রাট লালন শাহ্। যাঁর আরেক নাম ফকীর লালন সাঁই। তবে শিষ্যরা ডাকে সাঁইজী নামে। আজ থেকে প্রায় ২৩৫ বছর আগের কথা। ১৭৭৪ সালে তিনি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়ারা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তখন কুষ্টিয়া জেলা ছিল না। অবিভক্ত ভারতবর্ষেও নদীয়া জেলার অন্তর্গত মহকুমা ছিল। আর কুমারখালী ছিল ইউনিয়ন। লালন গড়াই নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভাড়ারা গ্রামের হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর বাবা ছিলেন শ্রী মাধব কর আর মা ছিলেন শ্রীমতি পদ্মাবতী। লালন বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান ছিলেন। শৈশবেই লালন তাঁর বাবাকে হারান। একমাত্র মায়ের আদর স্নেহে বেড়ে উঠেন তিনি। পরিবারের প্রধান বাবা বেঁচে না থাকায় সংসারের দায়-দায়িত্ব পড়ে লালনের কাঁধে। মা ছাড়া তখন তাঁর আর পৃথিবীতে কেউ ছিল না। মায়ের সেবার কথা ভেবে লালন বিয়ে করেন। লালন ব্যক্তি জীবনে ছিলেন নীতিবান। পরিবারের অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের সাথে তাঁর বনিবনা না হওয়ায় মা ও স্ত্রীকে নিয়ে একই গ্রামের দাসপাড়ায় নতুন করে বসতি গড়েন। সংসার চালাতে গিয়ে লালনের আর লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। তবে তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন গান বাজনার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ভাড়ারা গ্রামে কবিগান,পালাগান,কীর্তন সহ নানা রকম গানের আসর বসতো। লালন সেই আসরের একজন প্রিয়জন ছিলেন। তাঁর গান শুনে মানুষ মুগ্ধ হতো।
লালন পূন্যলাভের আশায় যৌবনের শুরুতে একদিন তাঁর ভাড়ারা গ্রামের দাসপাড়ার প্রতিবেশী বাউলদাস সহ অন্যান্য সঙ্গী-সাথী নিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে গঙ্গা স্নানে যান। সে সময় রাস্তা ঘাটের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। মাটির রাস্তা বর্ষায় কাদা আর গৃষ্মে ধুলো। তার উপর পায়ে হাঁটা ছাড়া কোন বাহন ছিলনা। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে মানুষ তার গন্তব্যে যেত। তবে সমাজের হাতে গোনা কয়েকটি উঁচু পরিবারের জন্য ঘোড়া কিংবা গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। তাও সংখ্যায় খুবই কম। গঙ্গা স্নান সেরে লালন সঙ্গীদের নিয়ে বাড়ী ফেরার পথে আকস্মিকভাবে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। রোগের যন্ত্রনা ক্রমেই বেড়ে গেলে এক পর্যায়ে লালন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এই দেখে সঙ্গী-সাথীরা তাঁকে মৃত ভেবে মুখাগ্নি করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। সঙ্গীরা বাড়ি ফিরে তাঁর মা ও স্ত্রীকে পথের মধ্যে লালনের করুন মৃত্যুর কথা জানায়। অসহায় মা ও স্ত্রী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অদৃষ্টের করুণ পরিহাস বলে তাদের এই মৃত্যুকে মেনে না নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। ধর্মমতে সমাজকে নিয়েই লালনের অন্ত্যষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
এদিকে নদীর জলে ভাসতে ভাসতে লালনের দেহ পৌছায় পাড়ে। এক মহিলা কলস কাখে নদীতে জল আনতে গিয়ে দেখে একজন জীবন্ত মানুষ পানিতে ভাসছে। তাঁর চোখের পাতা পড়ছে,হাত-পা নড়ছে এই দেখে মহিলা তাঁকে নদী থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে যায়। মহিলা ছিলেন মুসলিম ধর্মের এক কারিকর পরিবারের রমনী। সেখানে সেবা শশ্রুষা পেয়ে লালন সুস্থ্য হয়ে ওঠেন। তবে বসন্ত রোগে লালনের এক চোখ নষ্ট হয়ে যায় এবং মুখমন্ডলে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সুস্থ্য লালন নতুন জীবন ফিরে পেয়ে মনের আনন্দে ফেরেন তাঁর প্রিয় গ্রাম, প্রিয় মায়ের কাছে। সন্তানকে জীবিত দেখে তাঁর মা আনন্দে আত্মহারা। স্ত্রী তাঁর স্বামীকে ফিরে পেয়ে সৃষ্টিকর্তাকে জানায় কৃতজ্ঞতা। কিন্তু সকল আনন্দ কিছুক্ষণের মধ্যে হারিয়ে যায়। লালন জীবিত ফিরেছে শুনে গ্রামের লোক দলে দলে তাঁকে দেখতে আসে। সেই সাথে আসে সমাজপতিরা। তাঁরা সাফকথা জানিয়ে দেয় লালনের অন্তুষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এছাড়া সে মুসলমান বাড়ির জল খেয়েছে তাঁকে আর এই সমাজে থাকতে দেয়া হবে না। সেদিন ধর্মের অজুহাতে লালনকে সমাজ থেকে বিচ্যুত করা হয়। বিচ্যুত করা হয় মা ও স্ত্রীর কাছ থেকেও। দারুন কষ্ট আর মর্মবেদনা বুকে চেপে লালনকে চলে যেতে হয় বাড়ি ঘর সংসার মা স্ত্রী পরিবার পরিজন ছেড়ে। জন্মভূমির মায়া ছেড়ে যাওয়ার সময় তাঁর যে বেদনার সৃষ্টি হয়েছিল তা নাড়ি ছিড়ে যাওয়ার মতই। লালনের সাথে তাঁর স্ত্রী গৃহত্যাগী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু সমাজের শাসন,লোকচক্ষুর ভয়,ধর্মের বেড়াজাল তার সে পায়ে শিকল পরিয়ে দেয়। এই দু:খ যন্ত্রনা সইতে না পেরে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়।
যে ধর্মের জন্য লালন গঙ্গা স্নানে গিয়েছিলেন,যে গঙ্গা স্নানে গিয়ে লালনের জীবন বিপন্ন হতে চলেছিল সেই ধর্মের অজুহাতে তাঁকে সমাজপতিরা সমাজ বিচ্যুত করে এই মর্মবেদনা লালনকে দারুনভাবে পীড়া দেয়।মূলত: এখান থেকেই লালন ভাবনার বিকাশ ঘটে। সমাজ বিচ্যুত লালন মরমী সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সাথে যোগাযোগ ঘটে । সিরাজ সাঁই ছিলেন কাহার সমপ্রদায়ের একজন সাধক পুরুষ। এই সাধকের সান্নিধ্যে এসে লালন দিনে দিনে হয়ে উঠেন আধ্যাত্বিক চিন্তা চেতনার প্রধান পুরুষ। সিরাজ সাঁইকে গুরু হিসেবে গ্রহন করে লালন হয়ে উঠেন ফকীর লালন সাঁই । ফকীর লালন ছিলেন গুরুবাদে বিশ্বাসী। তাঁর গানে সে কথায় ফুটে ওঠেছে। তিনি বলেছেন-
গুরু,তুমি তন্ত্রের তন্ত্রী
গুরু,তুমি মন্ত্রের মন্ত্রী
গুরু,তুমি যন্ত্রের যন্ত্রী
না বাজাও বাজবে কেনে।।
গুরু,তুমি মন্ত্রের মন্ত্রী
গুরু,তুমি যন্ত্রের যন্ত্রী
না বাজাও বাজবে কেনে।।
লালনের ধারনা গুরু ঈশ্বরেরই প্রতিচ্ছায়া। গুরুকে ভক্তি শ্রদ্ধা জানালে তা ঈশ্বরকেই জানানো হয়। গুরু ছাড়া কোন সাধনা সাধ্য হয় না। গুরু সিরাজ সাঁই এর নির্দেশে লালন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে আখড়া করেন। প্রথম দিকে লালন ছেউড়িয়া গ্রামের কালীগাঙের পাড়ে গহীন বনের মধ্যে একটি আম গাছের নীচে বসে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। ধ্যান মগ্ন লালন কখনও জঙ্গল থেকে বের হতেন না। তিনি জঙ্গলের মধ্যেই আনমেল নামের এক প্রকার কচু খেয়ে থাকতেন। জঙ্গলের মধ্যে এই সাধক পুরুষের কথা এক কান দু’কান করে ছেউড়িয়া গ্রামের সবার কাছে পৌঁছে যায় । ছেঁউড়িয়া গ্রামটি ছিল কারিকর সমপ্রদায় প্রধান গ্রাম। কারিকরদের অনেকে লালনের পাশে এসে দাঁড়ায় । সাঁইজীর অনুমতি নিয়েই কারিকর সমপ্রদায় লালনের একটি আখড়া বাড়ি তৈরী করে দেয় এবং সবাই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করে । লালনের প্রথম পর্যায়ের শিষ্যত্ব গ্রহন করে ছেউড়িয়ার এই কারিকররাই। আধ্যাত্মিক সাধক লালন সাঁইয়ের সাধনার কথা কিছুদিনের মধ্যেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। লালন প্রথমদিকে আখড়ায় খুব কমই থাকতেন। শিষ্যদের নিয়ে তিনি পার্শ্ববর্তি অঞ্চল পাবনা,রাজশাহী,যশোর,ফরিদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁর মতবাদ গানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এই সময় তাঁর গানের জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ে। সাধারন মানুষ সে হোক হিন্দু কিংবা মুসলিম সবাই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করতে থাকে। কারন লালনের গানের মধ্যে তারা মানবমুক্তির ঠিকানা খুঁজে পায়। জাত-পাতহীন.ধর্ম-বর্নহীন সমাজের কথাই ছিল লালনের গানের মূল কথা।
লালন সাধক জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝেও ভুলে থাকতে পারেননি তাঁর মাকে। মায়ের আদর স্নেহের কথা স্মরণ করেছেন বারে বার। আধ্যাত্মিক জীবনের মধ্যেও বুকের পাঁজরে লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁর মাকে। দূর থেকেও তিনি ছিলেন তাঁর মায়ের অন্তর জুড়ে। এটা প্রমান হয় লালনের মায়ের মৃত্যু সংবাদ যখন তাঁর কানে আসে তখন তিনি আখড়া বাড়ি থেকে মায়ের শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের সব কিছু পাঠিয়ে দেন। খাবার দাবার থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব। লালনকে সমাজ থেকে বিচ্যুত করার পর তাঁর অসহায় মা ভেকশ্রিতা হয়ে ভাড়ারা গ্রামের বৈরাগী কুম্ভ মিত্রের আখড়ায় আশ্রয় নেন এবং জীবনের বাকি সময়টা এখানেই কাটিয়ে দেন ।
জাতের কারনে লালন সমাজ বিচ্যুত হয়। যার কারনে জাত-পাতের বিরুদ্ধে লালন গানের মাধ্যমে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর গানে উল্লেখ করেছেন-
জাত না গেলে পাইনে হরি
কি ছার জাতের গৌরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে।
লালন কয় জাত হাতে পেলে
পুড়াতাম আগুন দিয়ে ॥
কি ছার জাতের গৌরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে।
লালন কয় জাত হাতে পেলে
পুড়াতাম আগুন দিয়ে ॥
মধ্যযুগীয় কুসংস্কার আর ধর্মীয় গোঁড়ামীর সেই অন্ধকারের সময় যে সময় শিক্ষা নয় জাত-কুলই প্রধান বিষয় ছিল। সেই সময় লালন জাত-পাত,ধর্মীয় গোড়ামীর উর্ধ্বে উঠে মানুষের ভেতরের মানুষকে জাগানোর জন্য গান গেয়েছেন মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে। মানবতাবাদী মতাদর্শ প্রচার করতে গিয়ে লালনের শিষ্যরা নানা রকম বিপদের মুখে পড়েছেন। হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মেরই উঁচু জাতের সমাজপতিরা তাদের বিপক্ষ অবস্থান নেয়। বিভিন্ন জায়গায় তারা বাউলদের মাথার চুল কেটে,হাতের একতারা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে । তবুও বাউলরা তাদের আদর্শ থেকে পিছিয়ে যায়নি। বিশেষ করে লালনের মৃত্যুর পর বাউল নির্যাতনের সংখ্যা বেড়ে যায়। বাউল শীতল শাহ্ ও ভোলাই শাহ্’র মৃত্যুর পর এর সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। লালনের আখড়া বাড়ির জন্য তাঁর ভক্ত মলম শাহ্ কারিকরের দেয়া ১৬ বিঘা জমিসহ আখড়া বাড়ি ১৯৪৫সালের ১১ ডিসেম্বর নিলামে উঠে যায়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে লালনের ভক্ত ইসমাইল শাহ ১’শ সাত টাকায় চার আনায় উক্ত আখড়াবাড়ি লালনের নামে খরিদ করে তা রক্ষা করেন। এভাবে যুগে যুগে লালন ভক্তরা তাদের সাঁইজীর আদর্শ স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার জন্য সাহসী ভুমিকা পালন করেছেন।
লালন কোন ধর্মের এ নিয়েও চলেছে নানা জল্পনা কল্পনা। মুসলমানরা দাবী করেছে লালন মুসলিম ছিলেন আর হিন্দুরা ভেবেছে তাদেও ধর্মের। বিশেষ করে হিন্দু সমাজপতিরা লালনকে ধর্মেও অজুহাতে সমাজচ্যূত করার কারনে লালনের মধ্যে ধর্মেও প্রতি দারুন ক্ষোভের সৃষ্টি হয় । লালন গবেষকদের ধারনা লালন যখন সিরাজ সাঁই এর সান্নিধ্যে আসেন তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে থাকতে পারেন। তবে এ বিষয়ে লালন তাঁর গানের মাধ্যমে নিজের ধর্মীয় অবস্থান পরিস্কার কেও গেছেন। তিনি বলেছেন-
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন বলে জেতের কি রুপ দেখলাম না এ নজরে ॥
লালন বলে জেতের কি রুপ দেখলাম না এ নজরে ॥
এছাড়াও তিনি আরও পরিস্কার করেছেন তাঁর মৃত্যুপরবর্তি আচার আচরণ এর মাধ্যমে। ভক্তদের প্রতি তাঁর যে দিক নির্দেশণা ছিল তা দেখে এবং শুনে । তিনি জীবদ্দশায় বলে গেছেন তাঁর মৃত্যুও পর যেন কোন ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী দাফন করা না হয়। জানাযা কিংবা শ্মশানে হরির কীর্তন কোনটিই না করার নির্দেশনা দিয়ে যান। বরং যে ঘেও উনি বাস করেন সেই ঘরেই দাফনের কথা বলেন। এই মাজারকে ঘিরে বাউল উৎসবের কথা বলেছেন। লালনের সেই নির্দেশণা মোতাবেক তাঁর ভক্তরা বর্তমানে যেখানে মাজার সেটিই ছিল লালনের শোবার ঘর। আর সেই ঘরেই তাঁকে সমাহিত করা হয় কোন ধর্মীয় শাস্ত্র ছাড়াই। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে,লালন কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন না। তবে সব ধর্মের মানুষের সাথে তাঁর ছিল ভাল সম্পর্ক। সকল ধর্মের মানুষ তাঁকে আপন বলে জানতো। যার কারনে সকল ধর্মেও মানুষই লালনকে তাদের ধর্মে ও ভেবেছে। মুসলমানের সাথে তাঁর আহার-ব্যবহার থাকায় মুসলমানরা ভাবতো তিনি মুসলমান,বৈষ্ণব ধর্মেও মত পোষণ করতে দেখে হিন্দুরা তাঁকে বৈষ্ণব করতো। আবার জাতিভেদ মানতেন না নিরাকার পরমেশ্বেও বিশ্বাস দেখে ব্রাম্মদিগের মনে হতো তিনি eªv¤§ag©vej¤^x বলে মনে হতো। কিন্তু আসলে লালন বড় গুরুবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর শিষ্যরা লালনের উপাসনা ছাড়া আর কারও উপাসনা শ্রেষ্ঠ বলে মানতো না। সর্বদা ‘সাঁই’ছাড়া মুখে আর কোন কথা শোনা যেত না।
আধ্যাত্মিক ফকীর লালন সাঁই গানের মাধ্যমে সমাজের জাতিভেদ,উচু-নীচু,ধর্মীয় গোঁড়ামী,স্যুঁৎ প্রথার বিরুদ্ধে মানুষের চেতনা ফিরিয়ে আনেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে মানুষের বিবেককে জাগিয়েছেন । মানুষের ভেতরের পশুত্বকে হত্যা কেও মানবতার জয়গান গেয়েছেন। লালন ছিলেন ¯^wkw¶Z তবে তিনি বিবেকের পাঠশালা থেকে যে শিক্ষা নিয়েছিলেন তা আজও বিশ্বব্রম্মান্ডে চলছে গবেষনার পর গবেষণা। তাঁর পান্ডিত্য,তার জ্ঞানের যে গভীরতা তা আজ মানব জাতির কল্যানে ব্যবহার হচ্ছে। লালনকে কেউ কোন কিছু জিজ্ঞাসা করলে কিংবা জানতে চাইলে তিনি তৎক্ষনাৎ গানের মাধ্যমে জবাব দিতেন। আকস্মিকভাবে তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত যে গান আর সুর তা মানুষের অন্তরকে বিকশিত করতো। লালনের মনে যখন কোন ভাবের উদয় হতো তৎক্ষনাৎ তিনি ‘পোনা মাছের ঝাক’বলে সংকেত দিলেই শিষ্যরা দৌড়ে আসতো একতারা আর ডুগডুগি হাতে। সাথে সাথে খাতা-কলম নিয়ে ছুটে আসতেন মানিক শাহ পন্ডিত ও মনিরুদ্দিন শাহ । সাথে সাথে তারা লালনের কন্ঠের গান খাতায় লিখে ফেলতেন। লালনের ভক্তরা দাবী করে সাঁইজীর ১০হাজারের মত গান রয়েছে তবে গবেষকদের ধারনা তা হবে এক হাজারের মত। লালনের গান তাঁর কন্ঠ থেকে শিষ্যদের মাধ্যমে গনমানুষের কন্ঠে ছড়িয়ে পড়ে। যে গান এখন বাংলার সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
পৃথিবীতে যুগে যুগে সাধক পন্ডিৎ ব্যক্তিরা এসেছেন মানুষের কল্যানে, সমাজের কল্যানে। তাঁরা কখনও নিজেদেও কথা ভাবেননি। ভেবেছেন মানবজাতির কথা। মানুষের মুক্তি খুঁজেছেন, দেখিয়েছেন আলোর পথ। লালনের গান দেহকেন্দ্রীক। গ্রামের মানুষেরা এই গানকে দেহতত্ব বলে থাকে। অর্থাৎ লালন বিশ্বাস করেন এই মানব দেহের মধ্যেই সব আছে। এই দেহের মধ্যেই ভাবের মানুষ, মনের মানুষ, অচিন পাখি বাস করে। লালন মানবদেহকে কখনও ‘ঘর’ কখনও ‘খাঁচা’ আবার কখনও ‘আরশীনগর’ নামে ডেকেছেন।এ বিষয়ে তাঁর গানে উল্লেখ রয়েছে –
আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে
তাকে জনম-ভর একদিন দেখলাম নারে…
…না জেনে ঘরের খবর তাকাও কেন আসমানে
খুঁজলে আপন ঘরখানা, তুমি পাবে সকল ঠিকানা।
…আমার ঘরের চাবি পরের হাতে…
তাকে জনম-ভর একদিন দেখলাম নারে…
…না জেনে ঘরের খবর তাকাও কেন আসমানে
খুঁজলে আপন ঘরখানা, তুমি পাবে সকল ঠিকানা।
…আমার ঘরের চাবি পরের হাতে…
লালন মানবদেহের মাঝেই ধর্মকে খুঁজেছেন এইভাবে-
আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে
দেখ্ নারে মন ভেয়ে
দেশ-দেশান্তর দৌঁড়ে এবার
মরিস কেন হাঁপিয়ে ॥
আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে
দেখ্ নারে মন ভেয়ে
দেশ-দেশান্তর দৌঁড়ে এবার
মরিস কেন হাঁপিয়ে ॥
করে অতি আজম ভাক্কা
গঠেছে সাঁই মানুষ মক্কা
কুদরতি নূর দিয়ে।
গঠেছে সাঁই মানুষ মক্কা
কুদরতি নূর দিয়ে।
ও তার চারদ্বারে চার নূরের ইমাম
মধ্যে সাঁই বসিয়ে ॥
আবার হিন্দু সমপ্রদায়ের উদ্দেশ্যে লালন বলেছেন এইভাবে-
মধ্যে সাঁই বসিয়ে ॥
আবার হিন্দু সমপ্রদায়ের উদ্দেশ্যে লালন বলেছেন এইভাবে-
উপাসনা নাই গো তার
দেহের সাধন সর্ব-সার
তীর্থ-ব্রত যার জন্য
এ দেহে তার সকল মিলে।
দেহ নিয়ে লালন আরও বলেছেন এই ভাবে-
দেহের সাধন সর্ব-সার
তীর্থ-ব্রত যার জন্য
এ দেহে তার সকল মিলে।
দেহ নিয়ে লালন আরও বলেছেন এই ভাবে-
ঘরের মধ্যে ঘরখানা
খুঁজে দেখ মন এই থানা
ঘরে কে বিরাজ করে ॥
খুঁজে দেখ মন এই থানা
ঘরে কে বিরাজ করে ॥
আবার কখনও বলেছেন-
বাড়ির পাশে আরশিনগর
সেথা এক পড়শী বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে ॥
বাউল সম্রাট লালন কোন ধর্মকে অস্বীকার না করলেও প্রচলিত ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন। প্রচলিত আনুষ্ঠানিক ধর্মকেই তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। শাস্ত্রীয় ধর্মেও দেয়াল ভেঙ্গে তিনি খুঁজে পান মানব ধর্মেও এক বিশাল শষ্যক্ষেত্র। সেখানে মানব জাতি এক এবং অভিন্ন। লালন প্রচলিত হিন্দু ধর্মেও যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছেন। তাঁর অন্তরের লালনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে সেদিনের সেই ধর্মপূজারীরা। লালন নিজেকে দিয়েই উপলব্ধি করেছেন ধর্ম মানুষকে কিভাবে শোষণ করে, শাসন কেও এবং সমাজপতিরা কিভাবে নিজেদেও স্বার্থে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তিনি এই গন্ডি পেরিয়ে ধর্মপূজারীদের মনগড়া ফতোয়া থেকে নিপড়িত মানবজাতির মুক্তির জন্যই মানবতার পথ খুঁজে বের করেন। যেখানে শোষিত মানুষ তাদের অধিকার ফিরে পায়। ধর্ম হাতিয়ার নয় ধর্ম হবে মানবমুক্তির পথ। মুখোশধারী ধার্মীক,গতানুগতিক শাস্ত্রীয় ধর্মের রীতিনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে উদার,অসামপ্রদায়ীক,কল্যানমূখী ভাবনা চিন্তা ভাববাদী গানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। তিনি এক নির্ভৃত পল্লীতে বসে সমাজ সংস্কারে নিজেকে জড়িয়েছিলেন অত্যান্ত শক্তভাবে।
সেথা এক পড়শী বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে ॥
বাউল সম্রাট লালন কোন ধর্মকে অস্বীকার না করলেও প্রচলিত ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন। প্রচলিত আনুষ্ঠানিক ধর্মকেই তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। শাস্ত্রীয় ধর্মেও দেয়াল ভেঙ্গে তিনি খুঁজে পান মানব ধর্মেও এক বিশাল শষ্যক্ষেত্র। সেখানে মানব জাতি এক এবং অভিন্ন। লালন প্রচলিত হিন্দু ধর্মেও যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছেন। তাঁর অন্তরের লালনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে সেদিনের সেই ধর্মপূজারীরা। লালন নিজেকে দিয়েই উপলব্ধি করেছেন ধর্ম মানুষকে কিভাবে শোষণ করে, শাসন কেও এবং সমাজপতিরা কিভাবে নিজেদেও স্বার্থে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তিনি এই গন্ডি পেরিয়ে ধর্মপূজারীদের মনগড়া ফতোয়া থেকে নিপড়িত মানবজাতির মুক্তির জন্যই মানবতার পথ খুঁজে বের করেন। যেখানে শোষিত মানুষ তাদের অধিকার ফিরে পায়। ধর্ম হাতিয়ার নয় ধর্ম হবে মানবমুক্তির পথ। মুখোশধারী ধার্মীক,গতানুগতিক শাস্ত্রীয় ধর্মের রীতিনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে উদার,অসামপ্রদায়ীক,কল্যানমূখী ভাবনা চিন্তা ভাববাদী গানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। তিনি এক নির্ভৃত পল্লীতে বসে সমাজ সংস্কারে নিজেকে জড়িয়েছিলেন অত্যান্ত শক্তভাবে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ হয়েছে। লালনও এদেশের পথে পথে যুদ্ধ করেছেন । তবে সে যুদ্ধ অস্ত্র হাতে নয় একতারা হাতে। সে যুদ্ধ কোন রাজ্য জয়ের নয়, সে যুদ্ধ মানুষ হত্যার নয়। সে যুদ্ধ মানুষের ভেতরের মানুষকে বাঁচানোর-জাগানোর যুদ্ধ। অচেতন মানুষের চেতনা ফিরিয়ে আনার যুদ্ধ। সমাজ-সভ্যতা থেকে বর্বরতা, নির্যাতন চিরতেও বন্ধ করতে লালন আজীবন যুদ্ধ করেছেন। লালনের যখন জন্ম হয় তার মাত্র সতের বছর আগে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন হয়। হারিয়ে যায় বাংলার স্বাধীনতা। পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী হয় ভারতবর্ষ। দেশে শুরু হয় বৃটিশ বেনিয়াদেও জুলুম অত্যাচার নির্যাতন। সে সময় ভূমি ব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটে। শুরু হয় নতুন সামন্ত শ্রেনীর। অবশ্য লালনের সময়েই ইংরেজ শাসকদের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে শুরু হয় তিতুমীরের সংগ্রাম, সিপাহী বিদ্রোহ, ওহাবি-ফারায়জী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ। হিন্দু মেলা, জাতীয় কংগ্রেস গঠনের মাধ্যমে গণজাগরনের কাজ শুরু হয়। রামমোহনের ব্রাম্মধর্ম প্রবর্তন, বিদ্যাসাগরের সংস্কার কার্যক্রমও শুরু হয় এই সময়ে। কোলকাতা কেন্দ্রীক ‘বাবু কালচারের’ বাইেও প্রত্যান্ত গ্রামের এক জঙ্গলে বসে একতারার সুরে বাউল গানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন লালন। লালনের সে গান গ্রামের মেঠো পথ ছাড়িয়ে কোলকাতা শহেও পৌঁছেনি। তাছাড়া সে সময় হাই সোসাটির বাবুরা লালনের মত একজন মূর্খ্য অশিক্ষিত মানুষের কথা কেনই বা মনে করবেন? তবে মৃত্যুকালে লালন দশ হাজারের মত শিষ্য-ভক্ত রেখে গেলেও কালের বিবর্তনে আজ সারা বিশ্বজুড়ে তাঁর লক্ষ কোটি অনুসারী,ভক্ত যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। মানবতাবাদ আজকের আধুনিক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মতবাদ যা লালন যুগে যুগে ধারন এবং বাহন করেছেন। গানের মাধ্যমে সব মানুষের কাছে তাঁর বাণী পৌঁছে দিয়েছেন । লালন ধর্ম শাস্ত্রেও বাইেও মানুষের মুক্তি এবং শ্রষ্টা লাভের পথ খুঁজেছেন। তবে তা ছিল জাত-ক্থল-বংশ অহংকারকে দূরে সরিয়ে ধর্মকে মনের মধ্যে সহজ সরল ভাবে চিনতে চেষ্টা করেছেন। লালন মনে করেছেন ধর্ম হলো তাই যা ধারন করা হয়। বাউল মন যা ধারন কেও তাই- ই বাউলের ধর্ম। মানব আত্মার মুক্তির জন্য তাঁদেও জীবনভর যে সংগ্রাম তা কখনই সহজ ছিল না। হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মেরই যারা সমাজকে শাসন করেছে, সমাজের মানুষকে ধর্মেও চাবুকে নিজেদের আঘাত করেছে তারা সবাই লালনকে নাড়ার ফকির, অশিক্ষিত, মূর্র্খ্য বলে অপবাদ দিয়েছে। সেই সাথে অপপ্রচার করেছে তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে। খেটে খাওয়া পিছিয়ে পড়া মানুষেরা লালনের গান শুনে তাঁদের জীবনের সন্ধান পেয়েছে। খুঁজে পেয়েছে আত্মার শান্তি। মধ্যযুগের সমাজপতিদের রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা না করে তারা দলে দলে যোগ দেয় লালনের আখড়ায়। তাদেও প্রাণ ছুঁয়ে যায় এক তারার সুরে। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম কি নেই লালনের গানে। হৃদয়ের তানপুরা বেজে উঠে বাউল গানে। মন ভিজে যায় লালন রসে। এদেশে যুগে যুগে গান এসেছে মানুষের বিনোদনের খোরাক হয়ে। কিন্তু লালনের গান এসেছে জ্ঞানের আলো ছড়াতে। মানুষের অন্তও বিকশিত করতে। লালনের গান মানুষকে করেছে মানবতাবাদী, হৃদয়কে করেছে আকাশের মত উদার আর সাগরের মত গভীর। মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখিয়েছে। মানুষকে সেবা করলে শ্রষ্টাকে সেবা করা হয়। এ প্রসঙ্গে লালন তাঁর গানে বলেছেন-
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
সষ্টার সৃষ্টিকে ভালবাসলে পক্ষান্তরে স্রষ্টাকেই ভালবাসা হয় এ কথা প্রথম লালন সাঁই তাঁর গানের মধ্য দিয়েই বলে গেছেন। লালনের বাউল জীবনের পেছনে রয়েছে ধর্ম জিজ্ঞাসা,আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিকাশের পাশাপাশি সেই অন্ধকার যুগের ধর্মীয় গোঁড়ামী, ধর্ম ব্যবসায়ীদের স্বেচ্ছাচারী আচরন ও জাতিভেদেও মত পীড়াদায়ক ও বেদনা বিধূর ঘটনার অভিজ্ঞতা। শাস্ত্রমতে ধর্ম কর্ম করতে পারেনা অথচ বুকের মধ্যে ঈশ্বরকে লালন কেও এমন অবহেলিত মানবজাতির কথায় লালন তাঁর গানের মধ্যে বলেছেন লালন যৌবনের শুরুতে এক শ্রেনীর সুবিধাবাদী মানুষের কাছে দারুন লাঞ্চনার শিকার হয়ে সমাজচ্যুত হলেও পরবর্তি সময়ে তিনি মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন প্রচুর। তিনি কখনও মানুষকে অবজ্ঞা কিংবা অবহেলা করেননি। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি তাঁর এই টান তাঁকে ঐশ্বরিক টানের কাছে নিয়ে গেছে। যার কারনে তিনিু মানুষের মাঝেই ঈশ্বর খুঁজেছেন। যে সময় জাতিভেদ এবং ছুঁৎ মার্গ সমাজে প্রবল আকার ধারন করেছে সে সময় লালন সংগ্রাম বহু সংগ্রাম কেও এই শক্ত দেয়াল ভেঙ্গেছেন। সমাজবিজ্ঞানীরা লালনকে বাংলার নবজাগরনের পথিকৃত রামমোহনের সাথে তুলনা করেছেন।‘বাংলার নবজাগরণে রামমোহনের যে গুরুত্ব বাংলার লোকমানসের দেয়ালী উৎসবে লালনেরও সেই গুরুত্ব। দুই যমজ সন্তানের মতো তাঁদের দু’জনের জন্ম। দু’বছর আগে পরে । ইতিহাস-জননীর পক্ষে দুই বছর যেন দুই মিনিট। তবে এক সঙ্গে এলেও তাঁরা এক সঙ্গে যাননি। লালনের পরমায়ু যেন রাম মোহন ও বঙ্কিমচন্দ্রের জোড়া পরমায়ু। লোক সংস্কৃতিতে একক ব্যক্তিত্বেও এমন বিরাট উপস্থিতি আমাদের অভিভূত করে।
বাউল সম্রাট লালন সাঁই কারও বিপথ দেখে বসে থাকতে পারতেন না । তিনি একদিন খবর পেলেন কাঙাল হরিনাথের উপর হামলার জন্য জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী ধেয়ে আসছে। এই খবর পেয়ে লালন তাঁর শিষ্যদেও নিয়ে পাল্টা লাঠি হাতে জমিদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এতে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কাঙাল হরিনাথ ছিলেন সেই সময় কুমারখালী থেকে প্রকাশিত “গ্রামবার্ত্তা পত্রিকা’র” সম্পাদক। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি জমিদারদেও অত্যাচার নির্যাতন আর জুলুমের কথা ঐ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিল। এ থেকে প্রমান হয় সাধক লালন শোষিতের পক্ষে এবং শোষক শ্রেনীর বিরুদ্ধে ছিলেন। যে হাতে তিনি একতারা নিয়ে মানবতার গান গেয়ে চলেছেন প্রয়োজনে সেই হাতে লাঠি তুলতে কুন্ঠাবোধ করেননি। কারন সৎ পথে,সৎ কাজে তিনি ছিলেন অবিচল । যা তাঁর গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন-
সত্য বল সুপথে চল
ওরে আমার মন॥
ওরে আমার মন॥
মরমী সাধক লালন সাঁই এর সাথে কুমারখালী থেকে প্রকাশিত এদেশে বাংলা সংবাদপত্রের পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। কাঙালের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে উঠে বিষাদসিন্ধুর লেখক কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের সাথে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে বলে অধিকাংশ গবেষক লিখেছেন। তবে নির্ভরযোগ্য অনেক সুত্র বলে কবিগুরুর সাথে দেখা হয়নি। দেখা হয়েছিল কবিগুরুর বড় দাদার সাথে।
সাধক পুরুষ লালন শাহ্ সাধু দরবেশ হওয়া সত্বেও সংসার বিবাগী হননি। সংসারের প্রতি তার দারুন টান ছিল। এক মুসলিম মহিলা বয়ানকারীনির সাথে তিনি নিকাহ করেন এবং ভক্তদেও দেওয়া জায়গায় পানের বরজ করেন সংসার চালানোর জন্য। এছাড়াও তিনি মৃত্যুর আগে তাঁর পালিত কন্যা পিয়ারীর সাথে ভোলাই শাহ্’র বিবাহ সম্পন্ন করান। এ থেকেও স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি কন্যার বিয়ে,সংসারের জন্য পানের বরজ এসবই সংসারের প্রতি তাঁর ভালবাসার নিদর্শণ মাত্র।
১৮৯০সালের ১৭ অক্টোবর (১২৯৭ সালের ১ কার্তিক) শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টায় ১১৬ বছর বয়সে বাঙলা আর বাঙালীর হৃদয়ের মানুষ বাউল সম্রাট মরমী সাধক লালন শাহ্ ইন্তেকাল ত্যাগ করেন। যেদিন ভোরে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ঐ দিনও সারারাত ধরে আখড়ায় বাউল গান নিয়ে শিষ্য ভক্তদের সময় দিয়েছেন। ভোর ৫টায় তিনি সকল ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “আমি চলিলাম”। এই কথার আধা ঘন্টা পর তিনি সকলকে কাঁদিয়ে সত্যি সত্যিই একেবারে চলে যান।
আজ থেকে ২৩৫ বছর আগে লালন কুষ্টিয়ার অজো পাড়া গাঁয়ের এক জঙ্গলে বসে যে গান সৃষ্টি করেছেন তা ছিল আজকের আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার। যেখানে নারী-পুরুষ,জাত-পাত,উঁচু-নীচু কোন ভেদাভেদ থাকবে না। থাকবেনা ধর্মীয় সংঘাত-সংঘর্ষ। মানুষই হবে মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় অন্য কিছু নয়। থাকবেনা ছুঁতের ভয়। থাকবে না সমাজপতিদের শাসনের নামে শোষণ । এক আকাশের নীচে মানুষ সবাই সমান। কারও‘ ব্যক্তি কেউ বাঁধা দেবে না। যা কিছু ভাল তা নিয়েই হবে এই সমাজ। সেই মধ্যযুগে বসে গানের হাতুড়ি ছেনি দিয়ে ঘুনে ধরা সমাজকে একটু একটু কেও ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে গড়েছেন আজকের সভ্যতা। তিনি জানতেন তাঁর মানবদরদী গান একদিন ছেঁউড়িয়ার আকাশ পাড়ি দিয়ে তা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বেও সবখানে,সবমুখে উচ্চারিত হবে চরম ভক্তি শ্রদ্ধার সাথে । আর সেদিনই মানুষ হবে সত্যিকারের সোনার মানুষ। লালনের দর্শণ আজ সমাজের সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। মানুষের অন্তরে বেজে উঠছে একতারা। লালনের গান আজকের যান্ত্রীক পৃথিবীর মানুষের মন নরম কেও দেয়।মানুষের ভেতরের মানুষ অনুশোচনায় ডুকেও কেঁদে উঠে। মানুষের প্রতি মানুষের দরদ,শ্রদ্ধা,ভালবাসা বাড়িয়ে দেয় । হিংসা-বিদ্বেষ,হানাহানী থেকে বিবেককে দূরে সরিয়ে রাখে । লালনের গানপ্রিয় মানুষের মন পলি মাটির মত উর্বও থাকে। চেতনার বীজ বেড়ে উঠে ধীরে ধীরে । ধৈর্য্য-সহ্য শক্তি বাড়িয়ে দেয়। লোভ-লালসা থেকে দূরে রাখে । এক কথায় বলা যায় মানুষের প্রতি মানুষের টান,মাটির প্রতি ভালবাসা, মহান চিন্তা-চেতনার বিকাশ যা অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখায় সেটিই হলো লালন দর্শণ।
বাউল গানের ইতিহাস আরও পুরানো হলেও মূলত: লালনের সময় থেকে এটি প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পায়। লিখিতভাবে সংরক্ষিত হয়। কখনও বা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে আবার কখনও বা সংঘবদ্ধভাবে বাউল গান মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিয়ে তাঁদের দলে দলে ভক্ত ও শিষ্য তৈরীর কাজটি কেবল ফকীর লালন সাঁই কেও গেছেন। তাঁর মননে মানসে মানব মুক্তির গান। সময়ের সাথে সাথে বাউল সম্রাট মরমী সাধক ফকীর লালন শাহ্ আজ বিশ্বদরবারে দাপটের সাথে সমাদৃত। গ্রামের অবহেলিত লালন আজ আমাদের বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার একতারার সুর তরঙ্গ। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাববাদী দরবেশ। তাঁর একতারার সুর আজ জাগায় বাংলাদেশ। দেশে বিদেশে লালনের দর্শন নিয়ে চলছে গবেষণার পর গবেষণা। লালনের উৎস সন্ধানে এখনও বাউল গেয়ে চলে-
লালন তোমার আরশীনগর
আর কতদূর…আর কতদূর…
আর কতদূর…আর কতদূর…
'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি' - এই লাইনটি বাউল সম্রাট লালন সাঁইয়ের। তিনি মানুষের ভেতরের মানুষকে বাঁচানোর জন্য জীবনভর যুদ্ধ করে গিয়েছেন। ১৭৭৪ সালে তিনি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়ারা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। কুষ্টিয়া তখন জেলা ছিল না, অবিভক্ত ভারতবর্ষে নদীয়া জেলার অন্তর্গত মহকুমা ছিল। কুমারখালী ছিল তখন ইউনিয়ন। লালন গড়াই নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভাড়ারা গ্রামের হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর বাবা ছিলেন শ্রী মাধব কর আর মা ছিলেন শ্রীমতি পদ্মাবতী।
আমরা বরাবরই ভুলে যাই ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা মানুষ। আমাদের এই ভুলে যাওয়ার ফলাফল আজ আমরা বিশ্বব্যাপী দেখতে পাচ্ছি। দেশে দেশে যুদ্ধ, নিজের দেশের নাগরিকদের ওপর অত্যাচার সবই হচ্ছে ধর্মের নামে। কিছু মানুষ নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। আজ থেকে ২৪৩ বছর আগে লালনও মুখোমুখী হয়েছিলেন অসুস্থ সমাজ আর ধর্মব্যবসায়ীদের।
লালন শৈশবেই তার বাবাকে হারান। মায়ের আদর স্নেহে বেড়ে উঠেন তিনি। পরিবারের প্রধান বেঁচে না থাকায় লালন সংসারের হাল ধরেন। মায়ের দেখাশুনা করার জন্য লালন বিয়ে করেন। লালন খুব নীতিবান ছিলেন। তার প্রমান হলো আত্মীয় স্বজনদের সাথে তাঁর বনিবনা না হওয়ায় মা ও স্ত্রীকে নিয়ে একই গ্রামের দাসপাড়ায় নতুন করে বসতি গড়েন। তিনি শৈশব থেকেই সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, ফলে পড়াশোনা করতে পারেন নি। তবে গানের প্রতি তার অন্যরকম টান ছিলো। ভাড়ারা গ্রামে কবিগান,পালাগান,কীর্তন সহ নানা রকম গানের আসর বসতো। তিনি সেই আসর মাতানোর একজন ছিলেন। মানুষ মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনতো।
লালন পূন্যলাভের আশায় যৌবনের শুরুতে ভাড়ারা গ্রামের দাসপাড়ার প্রতিবেশী বাউলদাস সহ অন্যান্য সঙ্গী-সাথী নিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে গঙ্গা স্নানে যান। সে সময় রাস্তা ঘাটের অবস্থা খুব খারাপ ছিলো। সে সময় মানুষের একমাত্র পরিবহন ছিলো তাদের পা। পায়ে হেঁটেই মানুষ দূর -দূরান্তে যেতেন। কিছু কিছু ধনী পরিবারের জন্য ঘোড়া এবং গরুর গাড়ির প্রচলন ছিলো। তাও সংখ্যায় খুবই কম। গঙ্গা স্নান সেরে লালন যখন সঙ্গীদের সাথে বাড়ি ফিরছিলেন, তখন তিনি আকস্মিকভাবে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। রোগের যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সঙ্গীরা মনে করলেন তিনি মারা গেছেন। তারা তার মুখাগ্নি করেই নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। সঙ্গীরা তার মা এবং বউকে তার মৃত্যুর খবর দেন। অদৃষ্টের করুণ পরিহাস মনে করে তার মা এবং বউ তার মৃত্যু মেনে নেন এবং ধর্মমতে সমাজকে নিয়েই তার অন্ত্যষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেন।
অন্যদিকে নদীতে ভাসতে ভাসতে লালনের দেহ এক ঘাটে পৌঁছায়। এক মহিলা নদীতে পানি আনতে যেয়ে দেখেন একজন জীবন্ত মানুষ পানিতে ভাসছে। তাঁর চোখের পাতা পড়ছে,হাত-পা নড়ছে দেখে মহিলা তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। মহিলা এক মুসলিম পরিবারের রমণী ছিলেন। মহিলার সেবা শশ্রুষা পেয়ে লালন সুস্থ্য হয়ে ওঠেন। বসন্ত রোগে লালনের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায় এবং মুখাগ্নির কারণে তার মুখমন্ডলে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সুস্থ্য হয়ে লালন ফিরেন মায়ের কোলে, নিজ গ্রামে।
পুত্রের ফিরে আসায় মা আনন্দে আত্মহারা আর স্বামীর ফিরে আসায় স্ত্রী কৃতজ্ঞতা জানায় সৃষ্টিকর্তাকে। মৃত মানুষ ফিরে এসেছে এই খবর শুনে আশেপাশের মানুষজন লালনকে দেখতে আসে। সমাজপতিরাও আসেন লালনকে দেখতে। তবে যতটা না দেখতে তার থেকে বেশি তাদের নিয়মনীতি দেখতে। সমাজপতিদের সাফ কথা লালনের অন্তুষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং সে মুসলমান বাড়ির জল খেয়েছে তাই তাঁকে আর এই সমাজে থাকতে দেয়া যাবে না। সেদিন ধর্মের অজুহাতে লালনকে সমাজ থেকে বের করে দেয়া হয়। বিচ্যুত করা হয় মা ও স্ত্রীর কাছ থেকেও। লালনের স্ত্রী লালনের সাথে গৃহত্যাগী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু সমাজের শাসন,লোকচক্ষুর ভয়,ধর্মের বেড়াজাল তার সে পায়ে শিকল পরিয়ে দেয়। এই দু:খ যন্ত্রনা সইতে না পেরে লালনের স্ত্রী কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন ।
ধর্মের অজুহাতে সমাজপতিরা তাঁকে সমাজ থেকে বিচ্যুত করে এই মর্মবেদনা লালনকে দারুনভাবে পীড়া দেয়। মূলত: এখান থেকেই তার ভাবনার বিকাশ ঘটে। সমাজ বিচ্যুত লালন মরমী সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সাথে যোগাযোগ ঘটে । সিরাজ সাঁই ছিলেন কাহার সম্প্রদায়ের একজন সাধক পুরুষ। এই সাধকের সান্নিধ্যে এসে লালন দিনে দিনে হয়ে উঠেন আধ্যাত্বিক চিন্তা চেতনার পুরুষ। সিরাজ সাঁইকে গুরু হিসেবে গ্রহন করে লালন হয়ে উঠেন ফকীর লালন সাঁই । ফকীর লালন ছিলেন গুরুবাদে বিশ্বাসী।
লালন বিশ্বাস করতেন গুরু ঈশ্বরেরই প্রতিচ্ছায়া। গুরুকে ভক্তি শ্রদ্ধা করলে তা ঈশ্বরই পাবেন। গুরু ছাড়া কোনো সাধনায় সাধ্য হবে না। গুরু সিরাজ সাঁই এর নির্দেশে লালন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে আখড়া করেন। প্রথম দিকে লালন ছেউড়িয়া গ্রামের কালীগাঙের পাড়ে গহীন বনের মধ্যে একটি আম গাছের নীচে বসে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। ধ্যান মগ্ন লালন কখনও জঙ্গল থেকে বের হতেন না। তিনি জঙ্গলের মধ্যেই আনমেল নামের এক প্রকার কচু খেয়ে থাকতেন। জঙ্গলে এক সাধক পুরুষ আছে এই কথা এক কান দুই কান হতে হতে আশেপাশে ছড়িয়ে যায়। ছেঁউড়িয়া গ্রামটি ছিল কারিকর সম্প্রদায় প্রধান গ্রাম। সাঁইজীর অনুমতি নিয়েই কারিকর সমপ্রদায় লালনের একটি আখড়া বাড়ি তৈরী করে দেয় এবং সবাই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করে । লালনের প্রথম পর্যায়ের শিষ্যত্ব গ্রহন করে ছেউড়িয়ার এই কারিকররাই। লালন প্রথমদিকে আখড়ায় খুব কমই থাকতেন। শিষ্যদের নিয়ে তিনি পার্শ্ববর্তি অঞ্চল পাবনা,রাজশাহী,যশোর,ফরিদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁর মতবাদ গানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এই সময় তাঁর গানের জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ে। সাধারন মানুষ সে হোক হিন্দু কিংবা মুসলিম সবাই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করতে থাকে। কারন লালনের গানের মধ্যে তারা মানবমুক্তির ঠিকানা খুঁজে পায়। জাত-পাতহীন.ধর্ম-বর্নহীন সমাজের কথাই ছিল লালনের গানের মূল কথা।
লালনকে সমাজ থেকে বিচ্যুত করা এবং তার স্ত্রির মৃত্যুর পর তার অসহায় মা ভেকশ্রিতা হয়ে ভাড়ারা গ্রামের বৈরাগী কুম্ভ মিত্রের আখড়ায় আশ্রয় নেন এবং জীবনের বাকি সময়টা এখানেই কাটিয়ে দেন। লালন মায়ের মৃত্যুর খবর শুনার পর মায়ের শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের সব কিছু পাঠিয়ে দেন। খাবার দাবার থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র। আধ্যাত্মিক জীবনের মধ্যেও বুকের পাঁজরে লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁর মাকে।
যে জাতের কারণে লালনকে সমাজ থেকে, পরিবার থেকে বিচ্যুত করা হয়েছিলো, সেই জাত-পাতের বিরুদ্ধে লালন গানের মাধ্যমে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর গানে উল্লেখ করেছেন-
" জাত না গেলে পাইনে হরি
কি ছার জাতের গৌরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে।
লালন কয় জাত হাতে পেলে
পুড়াতাম আগুন দিয়ে ॥ "
মধ্যযুগীয় কুসংস্কার আর ধর্মীয় গোঁড়ামীর সেই অন্ধকারের সময়ে জাত-কুলই প্রধান বিষয় ছিল। লালন মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে জাত-পাত,ধর্মীয় গোড়ামীর উর্ধ্বে উঠে মানুষের ভেতরের মানুষকে জাগানোর জন্য গান গেয়েছেন। মানবতাবাদী মতাদর্শ প্রদর্শন এবং প্রচার করার কারণে লালনের শিষ্যরা নানা রকম বিপদের মুখে পড়েছেন। হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মেরই উঁচু জাতের সমাজপতিরা তাদের বিপক্ষ অবস্থান নেয়। বিভিন্ন জায়গায় তারা বাউলদের মাথার চুল কেটে,হাতের একতারা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে । তবুও বাউলরা তাদের আদর্শ থেকে পিছিয়ে যায়নি। বিশেষ করে লালনের মৃত্যুর পর বাউল নির্যাতনের সংখ্যা বেড়ে যায়। বাউল শীতল শাহ্ ও ভোলাই শাহ্’র মৃত্যুর পর এর সংখ্যা আরও বেড়ে যায়।
লালনের আখড়া বাড়ির জন্য তার এক ভক্ত মলম শাহ্ কারিকর ১৬ বিঘা জমি দেন। ১৯৪৫সালের ১১ ডিসেম্বর এই আখড়া বাড়িটি নিলামে উঠে যায়। তারপর লালনের অন্য এক ভক্ত ইসমাইল শাহ ১’শ সাত টাকায় চার আনায় উক্ত আখড়াবাড়ি লালনের নামে খরিদ করে তা রক্ষা করেন। যুগে যুগে লালন ভক্তরা তাদের সাঁইজীর আদর্শ স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার জন্য সাহসী ভুমিকা পালন করেছেন।
লালনের ধর্ম নিয়ে আছে নানা জল্পনা কল্পনা। মুসলমানরা দাবী করেন লালন মুসলিমের, হিন্দুরা দাবি করেন তিনি হিন্দুদের। লালন গবেষকদের ধারনা লালন যখন সিরাজ সাঁই এর সান্নিধ্যে আসেন তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে থাকতে পারেন। তবে এ বিষয়ে লালন তাঁর গানের মাধ্যমে নিজের ধর্মীয় অবস্থান পরিস্কার করে গেছেন। তিনি বলেছেন-
" সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন বলে জেতের কি রুপ দেখলাম না এ নজরে ॥ "
লালন তার ধর্মের অবস্থান আরো পরিষ্কার করে গেছেন তাঁর মৃত্যুপরবর্তি আচার আচরণ এর মাধ্যমে। তিনি জীবদ্দশায় বলে গেছেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন কোন ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী দাফন না করা হয়। জানাযা কিংবা শ্মশানে হরির কীর্তন কোনটিই না করার নির্দেশনা দিয়ে যান। তিনি বলে যান তিনি যে ঘরে বসেন সেখানে যেন দাফন করা হয়। এই মাজারকে ঘিরেই বর্তমানে বাউল উৎসব হয়। কোন ধর্মীয় শাস্ত্র ছাড়াই লালনকে দাফন করা হয়। লালন কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন না। তবে সব ধর্মের মানুষের সাথে তাঁর ছিল ভাল সম্পর্ক। সকল ধর্মের মানুষ তাঁকে আপন বলে জানতো, যার কারনে সকল ধর্মের মানুষই লালনকে তাদের ধর্মের ভেবেছে।
লালন সাঁই গানের মাধ্যমে সমাজের জাতিভেদ,উচু-নীচু,ধর্মীয় গোঁড়ামী,স্যুঁৎ প্রথার বিরুদ্ধে মানুষের চেতনা ফিরিয়ে আনেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে মানুষের বিবেককে জাগিয়েছেন । মানুষের ভিতরের পশুকে হত্যা করে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। লালনের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিলো না, তার ছিলো বিবেকের শিক্ষা। তিনি তার বিবেকের পাঠশালা থেকে যে শিক্ষা নিয়েছিলেন তা আজও বিশ্বব্রম্মান্ডে চলছে গবেষনার পর গবেষণা। তাঁর পান্ডিত্য, জ্ঞানের গভীরতা আজ মানব জাতির কল্যানে ব্যবহার হচ্ছে। লালন তার প্রতিটা কথার জবাব গানের মাধ্যমে দিতেন। আকস্মিকভাবে তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত সে গান আর সুর মানুষের অন্তরকে বিকশিত করতো।
লালনের মনে যখন কোন ভাবের উদয় হতো তখন তিনি ‘পোনা মাছের ঝাক’ বলে সংকেত দিতেন। এই সংকেত শোনার পর তার শিষ্যরা দৌড়ে আসতো একতারা আর ডুগডুগি হাতে। মানিক শাহ পন্ডিত ও মনিরুদ্দিন শাহ খাতা কলম নিয়ে ছুটে আসতেন। লালনের ভক্তরা দাবী করে সাঁইজীর ১০হাজারের মত গান রয়েছে তবে গবেষকদের ধারনা তা হবে এক হাজারের মত। লালনের গান তাঁর কন্ঠ থেকে শিষ্যদের মাধ্যমে গনমানুষের কন্ঠে ছড়িয়ে পড়ে। যে গান এখন বাংলার সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
পৃথিবীতে সব সাধক পন্ডিৎ ব্যক্তিরা সেছেন মানুষের কল্যানে, সমাজের কল্যানে। তারা কখনো নিজেদের নিয়ে ভাবেন নি। তারা মানুষের মুক্তির পথ খুঁজেছেন, দেখিয়েছেন আলোর পথ। লালনের গান দেহকেন্দ্রীক। গ্রামের মানুষেরা এই গানকে দেহতত্ব বলে থাকে। লালন বিশ্বাস করতেন এই মানব দেহের মধ্যেই সব আছে। এই দেহের মধ্যেই ভাবের মানুষ, মনের মানুষ, অচিন পাখি বাস করে। লালন মানবদেহকে কখনও ‘ঘর’ কখনও ‘খাঁচা’ আবার কখনও ‘আরশীনগর’ নামে ডেকেছেন।এ বিষয়ে তাঁর গানে উল্লেখ রয়েছে –
"আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে
তাকে জনম-ভর একদিন দেখলাম নারে…"
বাউল সম্রাট লালন কোন ধর্মকে অস্বীকার না করলেও প্রচলিত ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন। শাস্ত্রীয় ধর্মের দেয়াল ভেঙ্গে তিনি খুঁজে পান মানব ধর্মের এক বিশাল শষ্যক্ষেত্র। লালন প্রচলিত হিন্দু ধর্মেও যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছেন। লালন নিজেকে দিয়েই উপলব্ধি করেছেন ধর্ম মানুষকে কিভাবে শোষণ করে, শাসন কেও এবং সমাজপতিরা কিভাবে নিজেদেও স্বার্থে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ধর্ম হাতিয়ার নয় ধর্ম হবে মানবমুক্তির পথ। তিনি এক নির্ভৃত পল্লীতে বসে সমাজ সংস্কারে নিজেকে জড়িয়েছিলেন অত্যান্ত শক্তভাবে।
লালন জন্মের সতের বছর আগে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন হয়। হারিয়ে যায় বাংলার স্বাধীনতা। দেশে শুরু হয় বৃটিশ বেনিয়াদের জুলুম অত্যাচার নির্যাতন। সে সময় ভূমি ব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটে। শুরু হয় নতুন সামন্ত শ্রেনীর। অবশ্য লালনের সময়েই ইংরেজ শাসকদের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে শুরু হয় তিতুমীরের সংগ্রাম, সিপাহী বিদ্রোহ, ওহাবি-ফারায়জী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ।
হিন্দু মেলা, জাতীয় কংগ্রেস গঠনের মাধ্যমে গণজাগরনের কাজ শুরু হয়। রামমোহনের ব্রাম্মধর্ম প্রবর্তন, বিদ্যাসাগরের সংস্কার কার্যক্রমও শুরু হয় এই সময়ে। কোলকাতা কেন্দ্রীক ‘বাবু কালচারের’ বাইেও প্রত্যান্ত গ্রামের এক জঙ্গলে বসে একতারার সুরে বাউল গানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন লালন। মৃত্যুকালে লালন দশ হাজারের মত শিষ্য-ভক্ত রেখে গেলেও কালের বিবর্তনে আজ সারা বিশ্বজুড়ে তাঁর লক্ষ কোটি অনুসারী,ভক্ত যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। মানবতাবাদ আজকের আধুনিক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মতবাদ যা লালন যুগে যুগে ধারন এবং বাহন করেছেন। গানের মাধ্যমে সব মানুষের কাছে তাঁর বাণী পৌঁছে দিয়েছেন ।
লালন মনে করেছেন ধর্ম হলো তাই যা ধারন করা হয়। বাউল মন যা ধারন করে তাই- ই বাউলের ধর্ম। মানব আত্মার মুক্তির জন্য তাদের জীবনভর যে সংগ্রাম তা কখনই সহজ ছিল না। হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মেরই যারা সমাজকে শাসন করেছে, সমাজের মানুষকে ধর্মেও চাবুকে নিজেদের আঘাত করেছে তারা সবাই লালনকে নাড়ার ফকির, অশিক্ষিত, মুখ্য বলে অপবাদ দিয়েছে। সেই সাথে অপপ্রচার করেছে তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে। খেটে খাওয়া পিছিয়ে পড়া মানুষেরা লালনের গান শুনে তাঁদের জীবনের সন্ধান পেয়েছে। খুঁজে পেয়েছে আত্মার শান্তি। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম কি নেই লালনের গানে। হৃদয়ের তানপুরা বেজে উঠে বাউল গানে।
যুগে যুগে গান এসেছে মানুষের বিনোদনের খোরাক হয়ে। কিন্তু লালনের গান এসেছে জ্ঞানের আলো ছড়াতে। মানুষের অন্তরকে বিকশিত করতে। লালনের গান মানুষকে করেছে মানবতাবাদী, হৃদয়কে করেছে আকাশের মত উদার আর সাগরের মত গভীর। মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখিয়েছে। মানুষকে সেবা করলে স্রষ্টাকেই সেবা করা হয়। সষ্টার সৃষ্টিকে ভালবাসলে পক্ষান্তরে স্রষ্টাকেই ভালবাসা হয় এ কথা প্রথম লালন সাঁই তাঁর গানের মধ্য দিয়েই বলে গেছেন। লালনের বাউল জীবনের পেছনে রয়েছে ধর্ম জিজ্ঞাসা,আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিকাশের পাশাপাশি সেই অন্ধকার যুগের ধর্মীয় গোঁড়ামী, ধর্ম ব্যবসায়ীদের স্বেচ্ছাচারী আচরন ও জাতিভেদেও মত পীড়াদায়ক ও বেদনা বিধূর ঘটনার অভিজ্ঞতা।
যৌবনের শুরুতে এক শ্রেনীর সুবিধাবাদী মানুষের কাছে দারুন লাঞ্চনার শিকার হয়ে সমাজচ্যুত হলেও পরবর্তি সময়ে তিনি মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন প্রচুর। তিনি কখনও মানুষকে অবজ্ঞা কিংবা অবহেলা করেননি। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি তাঁর এই টান তাঁকে ঐশ্বরিক টানের কাছে নিয়ে গেছে। যার কারনে তিনিু মানুষের মাঝেই ঈশ্বর খুঁজেছেন। যে সময় জাতিভেদ এবং ছুঁৎ মার্গ সমাজে প্রবল আকার ধারন করেছে সে সময় লালন সংগ্রাম বহু সংগ্রাম কেও এই শক্ত দেয়াল ভেঙ্গেছেন। সমাজবিজ্ঞানীরা লালনকে বাংলার নবজাগরনের পথিকৃত রামমোহনের সাথে তুলনা করেছেন।‘বাংলার নবজাগরণে রামমোহনের যে গুরুত্ব বাংলার লোকমানসের দেয়ালী উৎসবে লালনেরও সেই গুরুত্ব। দুই যমজ সন্তানের মতো তাঁদের দু’জনের জন্ম। দু’বছর আগে পরে । ইতিহাস-জননীর পক্ষে দুই বছর যেন দুই মিনিট। তবে এক সঙ্গে এলেও তাঁরা এক সঙ্গে যাননি। লালনের পরমায়ু যেন রাম মোহন ও বঙ্কিমচন্দ্রের জোড়া পরমায়ু। লোক সংস্কৃতিতে একক ব্যক্তিত্বেও এমন বিরাট উপস্থিতি আমাদের অভিভূত করে।
বাউল সম্রাট লালন সাঁই কারো বিপদ দেখলে বসে থাকতে পারতেন না । তিনি একদিন খবর পেলেন কাঙাল হরিনাথের উপর হামলার জন্য জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী ধেয়ে আসছে। এই খবর পেয়ে লালন তাঁর শিষ্যদেও নিয়ে পাল্টা লাঠি হাতে জমিদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এতে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কাঙাল হরিনাথ ছিলেন সেই সময় কুমারখালী থেকে প্রকাশিত “গ্রামবার্ত্তা পত্রিকা’র” সম্পাদক। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি জমিদারদের অত্যাচার নির্যাতন আর জুলুমের কথা ঐ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিল। সৎ পথে,সৎ কাজে তিনি ছিলেন অবিচল । যা তাঁর গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন-
' সত্য বল সুপথে চল
ওরে আমার মন॥ '
লালন সাঁই এর সাথে কুমারখালী থেকে প্রকাশিত এদেশে বাংলা সংবাদপত্রের পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। কাঙালের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে উঠে বিষাদসিন্ধুর লেখক কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের সাথে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে বলে অধিকাংশ গবেষক লিখেছেন। তবে নির্ভরযোগ্য অনেক সুত্র বলে কবিগুরুর সাথে দেখা হয়নি। দেখা হয়েছিল কবিগুরুর বড় দাদার সাথে।
লালন সাধু দরবেশ হওয়া সত্বেও সংসারের প্রতি তার দারুন টান ছিল। এক মুসলিম মহিলা বয়ানকারীনিকে বিবাহ করেন এবং ভক্তদের দেওয়া জায়গায় পানের বরজ করেন সংসার চালানোর জন্য। এছাড়াও তিনি মৃত্যুর আগে তাঁর পালিত কন্যা পিয়ারীর সাথে ভোলাই শাহ্’র বিবাহ দেন।
১৮৯০সালের ১৭ অক্টোবর (১২৯৭ সালের ১ কার্তিক) শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টায় ১১৬ বছর বয়সে বাঙলা আর বাঙালীর হৃদয়ের মানুষ বাউল সম্রাট মরমী সাধক লালন শাহ্ ইন্তেকাল ত্যাগ করেন। যেদিন ভোরে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ঐ দিনও সারারাত ধরে আখড়ায় বাউল গান নিয়ে শিষ্য ভক্তদের সময় দিয়েছেন। ভোর ৫টায় তিনি সকল ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “আমি চলিলাম”। এই কথার আধা ঘন্টা পর তিনি সকলকে কাঁদিয়ে সত্যি সত্যিই একেবারে চলে যান।
No comments:
Post a Comment
Thank you for your message, I see all your messages, it is not possible to reply many times due to busyness, I hope I will reply to everyone in time, thank you for being with me.